ঘড়ির কাঁটা ডান দিকে ঘােরে কেন?




টিকটিক শব্দ করে ঘােরে ঘড়ির কাঁটা। কোনদিকে ঘােরে, আমরা তাে সবাই দেখি-ডান দিকে! কিন্তু কখনাে কি ভাবনায় এসেছে, কেন ডান দিকেই ঘােরে? বাঁ দিকে ঘুরলেই বা কী এমন সমস্যা? যদি নাই হয়, তাহলে ঠিক কী কারণে ঘড়ির কাটা কেবল ডান দিকেই ঘােরে? 





সবচেয়ে প্রাচীন যে ঘড়িগুলাে, সেগুলােতে কিন্তু কাঁটার ঘােরাঘুরির কোনাে বিষয় ছিল না। হ্যাঁ, সূর্যঘড়িই হলাে পৃথিবীর প্রাচীনতম ঘড়ি। এই সূর্যঘড়িও কিন্তু অনেক রকমের ছিল। সবচেয়ে প্রাচীন সূর্যঘড়ি বলা হয় মিসরীয়দের ওবেলিস্ককে। ধারণা করা হয়, মিসরীয়রা এই ঘড়ি বানানাে শিখেছিল খ্রিস্টের জন্মেরও সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। এ রকম আরেকটা ঘড়িকে বলা হয় ‘শ্যাডাে ক্লক'। ওটা বানিয়েছিল ব্যাবিলনীয়রা, খ্রিস্টের জন্মের হাজার দেড়েক বছর আগে।


এখন, এই সূর্যঘড়িগুলােতে সময় দেখা হতাে সূর্যের ছায়া দেখে। অর্থাৎ সময়-নির্দেশক যে কাঁটা বা দণ্ড, সেটা স্থির থাকত। সূর্যের আলােয় সে কাঁটার ছায়ার পরিবর্তন দেখেই সময় হিসাব করা হতাে। আর এখনকার ঘড়িতে আবার উল্টো, এই কাঁটাগুলােই ঘুরে ঘুরে সময় জানান দেয়। ছায়া দেখার কোনাে বালাই নেই। এই রকম ঘড়ি, মানে যেই ঘড়িতে কাঁটা ঘুরে ঘুরে সময় জানান দেয়, তেমন ঘড়ি প্রথম বানানাে হয় ১৩ শতকে। তবে তখনই এই ঘড়িগুলাে তেমন জনপ্রিয় হয়নি। হবে কী করে, তখনাে যে মানুষের সময় দেখার তেমন দরকারই পড়েনি। সূর্য দেখেই মানুষ দিব্যি বুঝে নিত যে এখন সকাল না দুপুর, বিকেল না সন্ধ্যা। সময় নিয়ে এরচেয়ে বেশি মাথা ঘামানাের তেমন দরকারই ছিল না। 





এরও মােটামুটি ৪০০ বছর পরে, ১৮ শতকে যখন কলকারখানা বসতে শুরু করল, তখন মানুষের নির্দিষ্ট করে সময় দেখার দরকার হতে শুরু করল। নির্দিষ্ট সময়ে কারখানায় যেতে হবে, নির্দিষ্ট সময়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার কাজে লাগতে হবে, নির্দিষ্ট সময়ে ছুটি হবে, কারখানার নিয়মটাই যে তেমন! তখন সবার ওই কাঁটাওয়ালা ঘড়ির দরকার পড়ল, যাতে সবাই সময়মতাে সব কাজ করতে পারে। ফলে ঘড়িও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল।


এবার একটা হিসাব মেলানাে যাক। যে অঞ্চলে পুরােনাে ঘড়িগুলাে তৈরি হয়েছিল, মিসর আর ব্যাবিলন—এগুলাে কিন্তু একই অঞ্চলে। অন্যান্য সূর্যঘড়িও কিন্তু মােটামুটি সেই সেই অঞ্চলের কাছাকাছিই তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ, এশিয়া আর ইউরােপের মাঝামাঝি যে অঞ্চল, পশ্চিমাদের পরিভাষা অনুযায়ী যাকে এখন বলা হয় মধ্যপ্রাচ্য। মিসর-ইরাক-ইরান-তুরস্ক ওই অঞ্চলে।


পৃথিবীর বিখ্যাত সব প্রাচীন সভ্যতাগুলাের বেশির ভাগই কিন্তু গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলেই। যেমন মিসরের মিসরীয় সভ্যতা, ইরাকের মেসােপটেমীয় সভ্যতা, ইরানের পারস্য সভ্যতা, তুরস্কের গ্রিক ও ট্রয়ের সভ্যতা। মেসােপটেমীয় সভ্যতার আবার চারটি ভাগ আছে—সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, অ্যাসিরীয় সভ্যতা আর ক্যালডীয় সভ্যতা। আর এ অঞ্চলের ভৌগােলিক অবস্থানের কারণে সূর্যঘড়ির ছায়া দিনের সঙ্গে ক্রমাগত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সরে যেত। অর্থাৎ, দিন যত গড়িয়ে রাতের দিকে যেত, ছায়াও তত পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে যেত। সেখান থেকেই ঘড়ির কাঁটার দিকের ব্যাপারটা এসেছে। সে অনুযায়ীই ঘড়ির কাঁটা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যায়।


এখন প্রশ্ন হলাে, পশ্চিম-পূর্বের সঙ্গে বাঁ ও ডানের কী সম্পর্ক? এবার তাহলে একটা মানচিত্র নিয়ে বসা যাক। মানচিত্রের ওপরের দিকে একটা দিকনির্দেশক চিহ্ন থাকে। তার পাশে লেখা থাকে এন বা নর্থ। মানে, মানচিত্রের ওপরের দিকটা হলাে নর্থ, বাংলায় যাকে বলে উত্তর। আর নিচের দিকটা হলাে দক্ষিণ। তাহলে হিসাবে বাঁ দিকে পড়ে পশ্চিম আর ডান দিকে পূর্ব দিক।


এ কারণেই ঘড়ির কাঁটা বাঁ দিক থেকে ডান দিকে যায়। মানে, আসলে ওটা বাঁ থেকে ডানে না, বলা উচিত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যায়।



Post a Comment

Please Validate The Captcha

Previous Post Next Post