সবুজ রঙের শিশু

 



ঘটনাটি যে সময়কার তখন ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন স্টিফেন (১১৩৫-১১৫৪)। দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে সাফোকের উলপিট নামের একটি গ্রামের লােকজনের মধ্যে হঠাৎ করেই দেখা যায় দারুণ চাঞ্চল্য। হবেই বা না কেন? চোখের সামনে জ্বলজ্যান্ত দুটি মানব শিশুর গায়ের রঙ যদি সবুজ হয়, তবে সবার পিলে চমকে যাবে বৈকি! 



তখন ছিল ধান চাষের সময়। মাঠে কাজ করতে থাকা কৃষকদের সামনে দিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে গ্রামের দিকে হেঁটে আসে দুটি ছােট ছেলে-মেয়ে। সাধারণতসবাই জানতাে ঐ জঙ্গলে নেকড়ে ছাড়া আর কিছু থাকে না। সেই ঘন জঙ্গল থেকে যখন দুটি মানব শিশু বের হয়ে আসে, তখন স্বভাবতই তাদের নিয়ে সবার উৎসাহ একটু বেশিই ছিল। তার উপর তাদের সবুজ গায়ের রঙ এবং উদ্ভট পােশাক দেখে বেশ ভালােই অবাক হয় গ্রামবাসী। কথা বলতে গিয়ে ঘটে আরেক মুসিবত! এমন এক ভাষায় কথা বলছিল বাচ্চা দুটো যে তার একটি অক্ষরও বুঝবে এমন সাধ্য কার আছে! কোত্থেকেই বা তারা আসলাে আর যাবেই বা কোথায়- কিছুই জানা সম্ভব হচ্ছিল না গ্রামবাসীর পক্ষে। 


শিশু দুটিকে সাথে সাথেই নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় জমিদার স্যার রিচার্ড ডি কেনের কাছে। তবে সেখানে গিয়ে বেশ কিছুদিন কিছু খেতে অস্বীকৃতি জানায় বাচ্চা দুটো। পরবর্তীতে মটরশুঁটি আর কাচা শিম এনে দেয়া হলে বেশ আগ্রহ নিয়েই খায় তারা। মজার বিষয় হলাে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে, তাদের সাথে চলতে চলতে নিজেদের গায়ের সবুজ বর্ণের পল্লব আস্তে আস্তে হারাতে থাকে দুই ভাই-বােন। তবে পরিবর্তিত এই পরিবেশে অভ্যস্ত হতে পারে না ছেলেটি। ধীরে ধীরে যতই সময় এগিয়ে যেতে থাকে ততই যেন বিষন্নতা ঘিরে ধরে বাচ্চাটিকে। দুজনের মধ্যে সে-ই ছিল ছােট। ছেলেটির এই মানসিক বিষন্নতা থেকে জন্ম নেয় বিভিন্ন অসুখ এবং খুব দ্রুতই মৃত্যুর মুখে পর্যবসিত হয় বাচ্চাটি।


অপরদিকে মেয়েটি নতুন জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে এবং অচিরেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। গ্রামে বসবাসরত একটি পরিবার তার দায়িত্ব নেয় এবং তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে শেখার পর তাকে তার অতীত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। সে অবশ্য নিজের সম্পর্কে খুব সামান্যই বলতে পেরেছিল। মেয়েটির সম্পর্কে একটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, “Rather loose and wanton in her conduct” অর্থাৎ পরিবেশের সাথে কোনােমতে খাপ খাইয়ে নিলেও তার আচরণে অমনােযােগিতা ও উদাসীনতা বেশ ভালােভাবেই লক্ষ্য করা যায়। 



মেয়েটি গ্রামবাসীকে জানায়, তারা দুই ভাই-বােন একদিন তাদের বাবার গরু খুঁজতে ফসলের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলাে। হঠাৎ করে পাশের গুহা থেকে এক অদ্ভুত ঘণ্টার শব্দ শুনতে পায় তারা। খুব জোরে জোরে ঘণ্টার শব্দ হওয়ায় চমকে যেয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে থাকে তারা। গুহার মধ্যে ঢুকে হারিয়ে যায় দুই ভাই-বােন। দীর্ঘক্ষণ ধরে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় গুহার অপর প্রান্তে এসে পৌছায় তারা। প্রখর সূর্যের আলােতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় দুজনের। 


হতবুদ্ধি অবস্থায় বেশ অনেকক্ষণ গুহার মুখে শুয়ে থাকে বাচ্চা দুটো। আস্তে আস্তে কৃষকদের কাজ করার শব্দ কানে আসলে সেদিকে হাঁটতে শুরু করে তারা। সব কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় গ্রামের লােকজন। কোন সে গ্রাম যেখানে সবুজ গাত্রবর্ণের অধিবাসীরা বাস করে তা খুঁজতে বের হয়ে যায় অভিযাত্রীর দল। কিন্তু মেয়েটির নির্দেশনা মােতাবেক গিয়ে নদী ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না তারা। বড় হয়ে মেয়েটি নর্টফোক রাজ্যের কিংস লিনের এক যুবককে বিয়ে করে যিনি ছিলেন রাজা দ্বিতীয় হেনরির মুখপাত্র। বলা হয়, পরবর্তী জীবনে মেয়েটি ‘আগনেস বাড়ৈ' নাম ধারণ করে। 


অস্বাভাবিক কোনাে ঘটনা দেখলে তা নিয়ে লােকমুখে গল্পের ডালপালা ছড়াবে এটা যেন চিরন্তন সত্যে পরিণত হয়েছে। এই শিশুকে নিয়েও প্রচলিত আছে বেশ কিছু মুখরােচক কাহিনী। কেউ কেউ বলেন বাচ্চা দুটো ছিল নরফোকের এক জমিদার বা আর্লের অভিভাবকত্বে। তাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে শিশুদের শরীরে আর্সেনিক প্রয়ােগ করে আর্ল। বিষের প্রভাবে দুই অনাথ শিশুর গায়ের রং হয়ে যায় সবুজ। কথাবার্তাওতে সেখান থে হয়ে যায় অসংলগ্ন। পরবর্তীকে পালিয়ে উলপিটে চলে আসে শিশু দুটি। কারাে কারাে মতে, বাচ্চা দুটি অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতায় ভুগছিল। তৎকালীন সময়ে এই অসুখটিকে বলা হত গ্রীন সিকনেস'। এই রােগের সাথে স্বল্প পরিচিত লােকজন সাদা, কালাে আর তামাটে ছাড়া একেবারেই ভিন্ন গায়ের রঙের দুটি শিশুকে দেখে হইচই ফেলে দেয় সর্বত্র। এমনকি তাদের ভিনগ্রহের বাসিন্দা বলতেও ছাড়েননি কেউ কেউ!


রূপকথার গল্পকে হার মানিয়ে দেয়ার মতাে বাস্তব এই ঘটনাটি নিয়ে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন সময় বেশ গুরুত্বসহকারে নানা ধরনের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ঐতিহাসিক পল হ্যারিসের মতে, ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরি ও তার বিরােধী শক্তি রবার্ট ডি বিউমন্টের মধ্যে ১১৭৩ সালের দিকে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে প্রাণ হারান অসংখ্য ফ্লেমিশ বা বেলজিয়ামের অধিবাসী। যুদ্ধস্থানটি ছিল সেন্ট অ্যাডমুন্ডসের উত্তরে। সেই যুদ্ধের সময়ে কোনাে এক ফ্লেমিশ পরিবার হয়তাে সেন্টমার্টিন গ্রাম থেকে পালিয়ে এসে উলপিট গ্রামের একটি নেকড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। দিনের পর দিন অন্ধকার ও খাদ্যাভাবে থাকার কারণে বাবা-মা মারা গেলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় শিশু দুটি। ফ্লেমিশ জামা-কাপড়ের সাথে পরিচয় না থাকায় উলপিটবাসীর কাছে তা উদ্ভট মনে হয়েছিল। আর বেলজিয়ামের সাথে কোনাে যােগাযােগ থাকায় ফ্লেমিশ ভাষা তারা বুঝবে বা জানবে এমন কোনাে কারণও নেই। এদিকে দীর্ঘদিন যাবত না খেয়ে থাকতে থাকতে বাচ্চা দুটোর শরীরে ক্লোরােসিস তৈরি হয়েছিল বলে তাদের গায়ের রঙ গাছের পাতার মতাে সবুজাভ হয়ে যায়। সুষম খাদ্য গ্রহণের ফলে দেহে ক্লোরােফিল নিঃসরণের মাত্রা কমে গিয়ে ক্লোরােসিস তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতাে বাচ্চা দুটোর গায়ের রঙ স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে স্বীকৃত এই কারণগুলাে শিশু দুটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া রহস্যের জাল গুটিয়ে আনে আস্তে আস্তে। বাস্তব জগতেরই এই দুই বাসিন্দা ভয়ে, আতঙ্কে আর অনাহারে নিজেদের শিশুমনে তৈরি করে নেয় রূপকথার রাজ্যের এক কল্পলােক যেখানে সবার গায়ের রঙই সবুজ বলে মনে করে তারা।


Post a Comment

Please Validate The Captcha

Previous Post Next Post