টাকা উড়ানো সহজ, কিন্তু উপার্জন করা বড় কঠিন !

Thank you for reading this Article. Please Share this and Support my Websites to Grow Further.




শিল্পপতি লােহানী সাহেবের ছেলের বাস্তব জীবনের গল্প !


ঘটনাটি ১৯৯৭ সনের, আমি আমার শিল্পপতি বাবা লােহানী সাহেবের একমাত্র ছেলে রবিন চৌধুরী। তখন আমি এ লেভেলের ছাত্র। একে তাে শিল্পপতির ছেলে তার উপর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করি ভাবই আলাদা। ফ্রেন্ডস নিয়ে ক্লাবে-ক্লাবে পার্টি, ট্যুর, নতুন –নতুন ড্রিংকস করা, সব কিছু মিলিয়ে অন্য
রকম একটা মাস্তির লাইফ কাটছিল।






বন্ধুদের মধ্যে আমার লিডার লিডার একটা ভাবছিলাে। তার কারণ আমি সবচেয়ে বেশি খরচ করতাম। একদিন প্লান করলাম বন্ধুরা মিলে থাইল্যান্ড যাব ট্যুরে। আর আমার এইবারের বার্থডে সেখানেই সেলিব্রেট করবাে। এর মধ্যে আমার দুই বন্ধু একটু গরীব তাদের খরচ আমাকে বহন করতে হবে। আজ বাবা বাসায় ড্রয়িং রুমে বসে কফি খাচ্ছে। বাবার সামনে যেতেই আমি কিছু বলার আগে বাবা বললাে এমাউন্ট কতাে?? না মানে বাবা সামনে আমার জন্মদিনতাে তাই মানে এই আর কি। বাবা উচ্চ স্বরে রেগে গিয়ে বললাে , আমি তােমাকে জিজ্ঞেস করেছি এমাউন্ট কত?? ২ লক্ষ বাবা। হুম!!! জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তুমি। জন্ম নিয়ে এই জাতিকে কৃতজ্ঞ করেছ, তােমার জন্মদিনে মাত্র ২ লক্ষ টাকা খরচ হবে কম হয়ে গেলনা??? এর মধ্যে মা চলে আসছে। কি হয়েছে?? আমাদের একমাত্র ছেলে এই সম্পদ সব কিছুইতাে একদিন ওর হবে। দিয়ে দাও, ওর মনে কষ্ট দিওনা। আমি যদি আমার ছেলেকে একটা উড়ন্ত বিমানের পাইলটের সিটে বসিয়ে তােমার ছেলের উপর প্লেনের দ্বায়িত্ব দিয়ে নেমে পরি। তখন কেমন হবে তুমিই বল?



শােন রবিনের মা এই সম্পদ একদিনে আসেনি। এর দায়িত্ব নিতেও নিজেকে যােগ্য করে তুলতে হয়। ঠিক আছে আমি তােমার ছেলেকে ২ লক্ষ টাকা দিব যদি সে আগামীকাল আমাকে পরিশ্রম করে ২০০ টাকা উপার্জন করে এনে দিতে পারে। সারা রাত নাক ডেকে ঘুমিয়েছি মাত্র ২০০ টাকা উপার্জন করতে হবে  , বাবা আগামী কালই দেখতে পারবে আমি তার সম্পদের দায়িত্ব নেয়ার মতাে যােগ্য হয়েছি।






পরের দিন সকাল ৭ টায় বাবা আমাকে ডেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিল। কি যে বিরক্ত লাগছিল মাত্র ২০০ টাকার জন্য এতাে সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে?? রেডি হয়ে একে বারে ফুল বাবু সেজে ২০০ টাকা
উপার্জন করতে বের হয়েছি। পকেটে এক টাকাও নাই সাথে বাবা একজন স্পাইও দিয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়ার পর এখন মনে হচ্ছে আমি একটা সমুদ্রের মাঝে পরে গেলাম। বিনা পুঁজিতে টাকা কোথায় পাই। কার কাছে থেকে ধার করতে পারছি না, কারাে সাহায্য নিতে পারছিনা। ভিক্ষাও করতে পারবাে না। ভাবতে ভাবতে দুপুর হয়ে গেল। অবশেষে একটা রিক্সার গ্যারেজে গেলাম, মনে মনে ভয়ও পাচ্ছিলাম অনেক মানুষ আছে রিক্সাওলার গায়ে হাত তুলে যদি আমাকে কেউ রিক্সাওয়ালা ভেবে মারে?? 


তখনি বিবেক আমাকে বুঝিয়ে দিল রিক্সাওয়ালাও আমারি মতাে মানুষ। তাদের গায়ে হাত তুলা অন্যায়। রিক্সার গ্যারেজে গেলাম কিন্তু অপরিচিত মানুষকে তারা রিক্সা দিবেনা। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলাে রিক্সা না
পেয়েছিতাে কি হয়েছে রিক্সা ঠেলতেতাে পারবাে। আমি আমার বাবার ছেলে এতাে সহজে হার মানবাে না। তখন উচুঁ -উচুঁ ব্রিজগুলােকে পেছন থেকে একজনকে রিক্সাওলার সাথে ঠেলে উঠিয়ে দিতে হতাে। বিনিময়ে যাত্রীরা ১ টাকা করে দিতাে। জীবনে কোন কাজ করিনি, এক গ্লাস পানিও নিজে ঢেলে খাইনি। আর আজ তপ্ত রােদে রিক্সা ঠেলেছি, এই ভাবে ১ ঘন্টায় ১০ টা রিক্সা ঠেলে ১০ টাকা উপার্জন করেছি, ১১ নাম্বার রিক্সা ঠেলতে গিয়ে পরে হাঁটু ছিঁড়ে গেল। আবার উঠে দাড়ালাম। যখন যাত্রী আমার হাতে ১ টাকার একটা কয়েন দিচ্ছিল তখন চোখ দিয়ে কেন যেন কান্না চলে আসলাে। ঘন্টা খানেক পর হাঠুর ব্যথা আরাে তিব্র হতে লাগলাে।



সন্ধ্যা পর্যন্ত গুনে দেখি মাত্র ৪০ টাকা হয়েছে। আর পারছি না। প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে মনে হচ্ছে শরীরও যেন নিজের সাথে প্রতারণা করছে, আমার সঙ্গ ছেড়ে দিচ্ছে। অবশেষে ৪০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। বাবার সামনে গিয়ে দাড়ালাম ৪০ টাকা বাবার হাতে দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললাম, আমি পারিনি বাবা। ভেবেছিলাম আমার বিধ্বস্ত ক্লান্ত চেহারা, হাটুর কাছে ছেঁড়া পেন্ট দেখে বাবাও হয়তাে কেঁদে দিবে। হয়তাে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিবে। 





না সে এগুলাে কিছুই করেনি। বরং আমাকে বললাে এখন আমার সাথে ধানমন্ডি থেকে হেঁটে বুড়িগঙ্গা সেতুর কাছে যাবে, কোন প্রশ্ন । আমি অবাক হলাম। এখন মনে হচ্ছে তিনি সত্যিই একজন ব্যবসায়ী। এরপরেও প্রশ্ন করলাম বাবা হেঁটে কেন। তিনি বললেন বাবা আমিতাে আজকের এই পজিশনে এই
ভাবে একটু-একটু করেই এগিয়ে এসেছি। গাড়ি বা বিমানের গতিতে আসিনি। তুমিতাে মাত্র একদিন কষ্ট করছে। একটু ধৈর্য ধর।


বাবাকে কি করে বুঝাই আমার ক্লান্তির কথা। এর চাইতে মৃত্যু যন্ত্রণা অধিক শ্রেয়। বাবা আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাত তিনটায় আমরা ব্রিজ উঠলাম। শান্ত নদী ব্রিজে আমি আর বাবা। ব্রিজের রেলিং ধরে দাড়িয়ে বাবা আমাকে বললাে দেখ রবিন নিচের কেমন অথৈই পানি টলমল করছে। তুমি আমার হাতে
৪০ টাকা দিয়েছে তাই না!!


জ্বি বাবা, আমার জীবনের প্রথম উপার্জন। আমি জানি রবিন এই টাকা গুলাে উপার্জন করতে তােমার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এখন তােমাকে যা বলি শােন। আমি জানি আমার ছেলে ছােট বেলা থেকেই ম্যাথমেটিক্সে খুবই ভাল। তাহলে ভাল গুনতেও পারাে আশা করি। এখন আমি তােমার উপার্জনের ৪০
টাকা দূর পানিতে ছুড়ে ফেলবাে আর তুমি বলতে থাকবে বাকি কয়টা রইলাে। 


বাবার কথা শুনে আমার চোখে আবার পানি চলে আসলাে। বাবা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা কয়েন সেতু থেকে দূরে পানিতে ছুড়ে ফেলে বললাে রবিন এখন কয়টা রইলাে। আমি কাদতে কাদতে বললাম বাবা ৩৯ টা। এই ভাবে এক-এক করে আমার চোখের সামনে আমার জীবনের প্রথম উপার্জিত এতাে কষ্টের সব গুলাে টাকা পানিতে ফেলতে লাগলাে আমি এক এক করে গুনছি। এমন একটি পরিস্থিতির বর্ননা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। শুধু জানি আমার চোখ থেকে ঝরে পরা প্রতিটি অশ্রু যেন কেরােসিনের তেলের মতােই আমার হৃদয়কে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। বাবা আমার গায়ে কোন দিন
হাত তুলেননি, কোন দিন একটা বকাও দেয়নি, আজ মনে হচ্ছে সব সুদে আসলে পুসিয়ে নিচ্ছে। শেষের টাকাটা বাবা ফেলােনা।


তারপর বললাে রবিন তােমার উপার্জনের ৪০ টাকা আজকে আমি নষ্ট করতে তুমি কাদলে আর আমার কতাে টাকা তুমি এইভাবে নষ্ট করেছাে কোথায় আমিতাে একবারও কাঁদিনি। তােমার অনুভুতিতে যেমন কষ্ট  লাগেছে আমারও ঠিক তেমনি অনুভূতি আছে কষ্ট উপলব্ধি করার জন্য। তােমার শেষের টাকা আমি রেখে দিলাম এটা আমার সন্তানের প্রথম উপার্জিত টাকা এটা এক জন পিতার জন্য গর্বের একটা প্রাপ্তি, এটা স্মৃতি হিসেবে আমি মৃত্যু পর্যন্ত সাথে রাখবাে। 


তুমি কাল তােমার মায়ের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা নিয়ে নিও। বাবার এই কথা গুলাে শুনার পর নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হচ্ছিল। আবেগ আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করতে করতে বললাম বাবা আমার টাকা লাগবে না।আমি এতাে দিন স্কুলে কলেজে কিছুই শিখিনি, যেটা তুমি আজকে শিখালে, তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। একজন আদর্শ বাবার চাইতে বড় শিক্ষক কেউ হতে পারেনা। একজন আদর্শ পিতাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। একজন বাবার দেওয়া সেরা উপদেশ;

১) কখনও কাউকে ছােট করে দেখবা না,
নইলে তুমি ছােট হয়ে যাবে।

২) জুতাে সেলাই করতে গিয়ে পা বাড়িয়ে দিও না ,
বরং জুতােটা নিজে একবার মুছে দিয়াে।
জুতাে কিনতে গেলে নিজের হাতেই জুতাে
পায়ে দিয়ে ফিটিং দেখাে।

৩) কখনও কামলা,কাজের লােক,বুয়া বলে
ডেকো না।। মনে রেখাে তারাও কারও না
কারও ভাই, বােন, মা বাবা। তাদের ভাই আপা
বলে ডেকো।

৪) পড়াশুনা করে জীবনে উন্নতি করাে কিন্তু
কারও ঘাড়ে পা দিয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করাে
না।

৫) কাউকে সাহায্য করে পিছনে ফিরে চেয় না,
 সে লজ্জা পেতে পারে।

৬) সবসময় দিতে চেষ্টা করবা।মনে রাখবা
প্রদানকারীর হাত সর্বদা উপরেই থাকে।

৭) এমন কিছু করাে না যার জন্য তােমার
এবং তােমার পরিবারের উপর আঙুল উঠে।

৮) ছেলে হয়ে জন্মাইছাে, দায়িত্ব এড়িয়ে
যেওনা।

৯) তােমার কি আছে তােমার গায়ে লিখা নেই,
কিন্তু তােমার ব্যবহারে আছে।

১০) কখনও মা কে শুনে বউকে এবং বউকে
শুনে মাকে বিচারে কাঠগড়ায় দাড় করিও না।
কাউকে ফেলতে পারবে না।

১১) যখন রাস্তায় হাটবে দেখে হাটবে, কেউ
পড়ে গেলাে কিনা।

১২) কারও বাসায় নিমন্ত্রন খেতে গেলেও
বাসায় এক মুঠো ভাত খেয়ে যাবে। যাতে
কারও বাড়ির ভাতের অপেক্ষায় না থাকতে
হয়।

১৩) কারও বাসার খাবার নিয়ে সমালােচনা
করবে না, কেউ খাবার অস্বাদু করার চেষ্টা
করো না।

১৪) বড়দের মাঝে তােমার চেয়ারটা বরাদ্দ
নেই, আছে ছােটদের মাঝে।

১৫) বড় হবার নয়, মানুষ হবার চেষ্টা করবা।
তবেই বড় হবা।

১৬) বাইক কখনও জোড়ে চালিও না, তাতে
তােমার কলিজার কাপুনি বেড়ে যেতে না
পারে, রাস্তার পাশে থাকা মানুষটার কাপুনি
বেড়ে যেতে পারে।

Post a Comment

Please Validate The Captcha

Previous Post Next Post